পাঠ্যক্রমে দেশভাগের দায় কংগ্রেস-জিন্নাহ-মাউন্টব্যাটেনের ঘাড়ে

ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা অনুসন্ধান ও প্রশিক্ষণ পরিষদ (NCERT) ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য নতুন পাঠ্যসূচি প্রকাশের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। নতুন পাঠ্যক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবল একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং তা ঘটেছিল তিনটি প্রধান শক্তি—মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সম্মিলিত ভূমিকার ফলে। নতুন পাঠ্যসূচিতে বলা হয়েছে, জিন্নাহ মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন, কংগ্রেস শেষপর্যন্ত তা মেনে নেয় এবং মাউন্টব্যাটেন সেই বিভাজন কার্যকর করেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর কংগ্রেসসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই পাঠ্যক্রমকে ইতিহাস বিকৃতির উদাহরণ বলে আখ্যায়িত করেছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরা এই পাঠ্যসূচিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ দাবি করে বলেন, "ইতিহাসকে বিকৃত করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় নেমেছে বিজেপি সরকার। এটি শুধু কংগ্রেসের ওপর আক্রমণ নয়, বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ইতিহাসের ওপর চরম আঘাত।" তিনি আরও বলেন, এই পাঠ্যসূচি পুড়িয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে কংগ্রেস ইতিহাস রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবে। বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ইতিহাসকে রাজনৈতিক অস্ত্র বানানোর’ অভিযোগ সমালোচকদের দাবি, এর আগেও মোদি সরকারের সময় পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে আরএসএস-এর সম্পর্কের তথ্য এবং ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার প্রসঙ্গ। এবার কংগ্রেসকে দেশভাগের জন্য সরাসরি দায়ী করে বিজেপি-আরএসএস তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে শিক্ষাক্ষেত্রেও বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিইআরটির এই পদক্ষেপ শিক্ষাকে নিরপেক্ষ রাখার মূলনীতিকে লঙ্ঘন করছে। তারা মনে করিয়ে দেন, দেশভাগ ছিল একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি, মুসলিম লীগের একগুঁয়ে মনোভাব, কংগ্রেসের রাজনৈতিক চাপ ও তৎকালীন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা—সবকিছু মিলিয়েই ঘটেছিল এই ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। কিন্তু বর্তমান পাঠ্যক্রমে একপাক্ষিকভাবে দায় চাপানো হচ্ছে কংগ্রেস ও মুসলিম নেতৃত্বের ওপর। আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন উঠতে পারে ভারতের ইতিহাস চর্চা নিয়ে বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, এই বিতর্ক শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও ভারতের শিক্ষানীতির নিরপেক্ষতা ও ইতিহাস চর্চার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক অবদানকে খাটো করা এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস ব্যাখ্যা করার প্রবণতা, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে আঘাত করছে বলে মনে করছেন অনেকে। ভারত ভাগের স্মৃতি কেবল আঞ্চলিক নয়, একটি আন্তর্জাতিক মানবিক বিপর্যয়। প্রায় দেড় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনার দায় একপাক্ষিকভাবে চাপানো শুধু ইতিহাসের প্রতি অবিচার নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তাভাবনায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির শঙ্কাও তৈরি করছে।